নিজেদের স্বপ্নে থাকুক অন্যের ভাগ by আরিয়ান আরিফ, প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক - মজার ইশকুল ( প্রথম আলো'র ২৭তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী'র লেখা )
প্রথম আলোর ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী: বিশেষ সংখ্যা
১। বাংলাদেশের সফলতার ইতিহাস মানে তারুণ্যের জয়গান
বাংলাদেশের ইতিহাসে এক সত্য চিরস্থায়ী, এই দেশ বারবার বেঁচে উঠেছে তরুণদের হাত ধরে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্রের লড়াই কিংবা প্রযুক্তির বিপ্লব, প্রতিটি পরিবর্তনের কেন্দ্রে ছিল তারুণ্য। আজ সেই তারুণ্য আবার দাঁড়িয়ে আছে এক নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে। আমার নিজের জীবনও সেই লড়াইয়েরই অংশ।
আজ প্রায় ১৩ বছরে মজার ইশকুল ছুঁয়েছে ২৩টি শাখা, ২,৩০০ নিয়মিত শিক্ষার্থী, ৮,০০০ নিবন্ধিত স্বেচ্ছাসেবী এবং প্রায় ১০ লাখের বেশি রান্না করা খাবার বিতরণ। আমরা শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নই, একটি আন্দোলন, যা বলছে: শিক্ষা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি জন্মগত অধিকার।
২। বৈষম্যের বাস্তবতা
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সাম্প্রতিক বলছে, দেশের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। UNICEF 2024 রিপোর্ট বলেছে, বর্তমানে ৩.৪ মিলিয়ন (নিবাসী অভিভাবক ছাড়া) শিশু রাস্তার পরিস্থিতিতে রয়েছে। রাস্তায় প্রতিদিন প্রায় চার লাখ শিশু বিভিন্ন শ্রমে যুক্ত, যাদের অনেকেই কখনো স্কুলে যায়নি।
একদিকে এয়ারকন্ডিশন ক্লাসরুমে ল্যাপটপ হাতে শিশু, অন্যদিকে ফুটপাথে খালি পায়ে বিক্রেতা শিশুরা, এই ফারাকই বৈষম্যের সবচেয়ে দৃশ্যমান চিত্র।
৩। তারুণ্যের জয়: মজার ইশকুলের যাত্রা
২০১৩ সালে আমি মাত্র ২১ বছর বয়সে মজার ইশকুল শুরু করি, ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, খোলা আকাশের নিচে। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, পথশিশু মুক্ত বাংলাদেশ গড়া। আমি চেয়েছিলাম এমন একটি দেশ, যেখানে কোনো শিশু রাস্তায় ঘুমাবে না।
এই অনুপ্রেরণা আমি পেয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা যোদ্ধা শহীদ শাফি ইমাম রুমির কাছ থেকে, যিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে দ্বিধা করেননি। তাঁর আদর্শই আমাকে শিখিয়েছে, দেশপ্রেম মানে শুধু যুদ্ধ নয়, বরং মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনার সংগ্রামও এক ধরনের মুক্তিযুদ্ধ।
মজার ইশকুলের যাত্রা শুরু হয়েছিল মাত্র ১৩ জন শিশু, কিছু রঙ পেন্সিল আর এক টুকরো আকাশ নিয়ে। আজ সেই ছোট উদ্যোগ পরিণত হয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ নেটওয়ার্কে, যেখানে শিক্ষা, পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা ও ডিজিটাল লার্নিং একসঙ্গে চলছে।
মজার ইশকুলের আছে দেশব্যাপী বিশাল স্বেচ্ছাসেবী দল ও নিবেদিত কর্মী বাহিনী, যারা প্রতিদিন নিজের সময়, শ্রম আর হৃদয়ের ভালোবাসা দিয়ে এই পরিবর্তনের কাজটি এগিয়ে নিচ্ছে। কেউ পড়ায়, কেউ মাঠে কাজ করে, কেউ শিশুদের খাবার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, সবাই মিলে এক মানবিক পরিবার। এই তরুণরাই মজার ইশকুলের প্রাণ। তাদের নিরলস পরিশ্রম ও অঙ্গীকার প্রমাণ করে দিয়েছে, তারুণ্যের জয় মানে শুধু নিজের ক্যারিয়ার নয়, বরং অন্যের জীবনে আলো জ্বালানো।
আমাদের মূল লক্ষ্য তাই স্পষ্ট, খাদ্য, শিক্ষা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতায় শিশুদের যোগ্য করে তোলা, যেন তারা একদিন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে কর্মে যুক্ত হতে পারে। এই কাজটিই আমাদের কাছে তারুণ্যের সবচেয়ে বড় জয়, যেখানে মানবিকতা আর বাস্তব উন্নয়ন একসঙ্গে চলে।
৪। Save the Children: প্রেরণা, নীতি ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ
শিশু-অধিকার রক্ষায় বৈশ্বিক ইতিহাসে Save the Children এমন এক সংগঠন, যারা নীতিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে প্রজন্ম বদলে দিয়েছে। ১৯১৯ সালে ব্রিটেনে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা ১৯২৪ সালে তাদের প্রতিষ্ঠাতা এগল্যান্টাইন জেব্ব রচিত Geneva Declaration of the Rights of the Child–এর মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম শিশু অধিকার কাঠামোর ভিত্তি গড়ে দেয়।
এই ঘোষণাপত্রই পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালের UN Convention on the Rights of the Child (UNCRC)–এর মূল প্রেরণা হয়, যা আজ ১৯৬টি রাষ্ট্রে আইনগতভাবে কার্যকর। এমনকি দক্ষিণ এশিয়াতেও Save the Children বিভিন্ন দেশের শিশু আইন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ নীতি, পুষ্টি ও শিশুর নিরাপত্তা বিষয়ক কাঠামো প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। উদাহরণস্বরূপ, ফিলিপাইন ২০১৮ সালের First 1000 Days Law, নেপালের ২০১৮ সালের শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ আইন, কেনিয়ার ২০২২ সালের Children Act কিংবা সিয়েরা লিওনের ২০২৪ সালের শিশুবিবাহ নিষিদ্ধ আইন, সব ক্ষেত্রেই তাদের নীতিগত অ্যাডভোকেসি ও প্রমাণভিত্তিক কাজ প্রভাব ফেলেছে।
বাংলাদেশেও ২০১৩ সালের Children Act এবং ২০১৭ সালের Child Marriage Restraint Act–এর প্রেক্ষাপটে Save the Children শিশু-অধিকারভিত্তিক গবেষণা, বাজেট বিশ্লেষণ ও পলিসি এডভোকেসিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।
একজন বাংলাদেশি ও মজার ইশকুলের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমি এই ইতিহাসে প্রেরণা খুঁজে পাই। কারণ আমি বিশ্বাস করি, পথশিশু মুক্ত বাংলাদেশ গঠনের লড়াই কোনো একক সংগঠনের পক্ষে সম্ভব নয়।
একটি উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে সরকার, নীতিনির্ধারক, উন্নয়ন সংগঠন, করপোরেট সেক্টর ও তরুণ সমাজ, সবাইকে একই লক্ষ্য ও তথ্যভিত্তিক কাঠামোর ভেতর কাজ করতে হবে। মজার ইশকুল আগামী দশকে নিজেকে সেই নীতি-সহায়ক স্তরে উন্নীত করতে চায়, যেখানে আমাদের কাজ শুধু শিক্ষাদান নয়, বরং রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে সক্ষম প্রমাণভিত্তিক অভিজ্ঞতা ও তথ্য প্রদান।
আমরা চাই শিক্ষা, পুষ্টি, শিশু-সুরক্ষা ও পুনর্বাসন, এই চারটি খাতে আমাদের মাঠের অভিজ্ঞতা সরকার ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর নীতিমালায় প্রতিফলিত হোক।
Save the Children–এর মতো সংগঠন আমাদের কাছে শুধু সহযোগী নয়, বরং কাঠামোগত প্রেরণা, যারা দেখিয়েছে, কিভাবে একটি প্রতিষ্ঠান শতবর্ষ ধরে রাষ্ট্রের নীতিকে মানবিকতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। মজার ইশকুলও সেই পথেই হাঁটতে চায়, সিভিল সোসাইটি, বেসরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠান, নীতিনির্ধারক ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে যৌথভাবে “Street-Children-Free Bangladesh” গঠনে একটি কার্যকর policy ecosystem তৈরি করতে।
আমাদের বিশ্বাস, যে রাষ্ট্র শিশুদের জন্য নীতি তৈরি করে এবং তা বাস্তবায়নে সাহস দেখায়, সেই রাষ্ট্রই ভবিষ্যতের জন্য টেকসই। মজার ইশকুল সেই বাস্তবতাকে অনুধাবন/প্রমান করাতে চাই যে, যে পরিবর্তন আইন দিয়ে শুরু হয়, তা বাস্তবতায় রূপ নেয় মাঠের কাজে।
৫। বৈষম্য মুক্তির বাংলাদেশ: এক নতুন স্বপ্ন
আমি কল্পনা করি এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে কোনো শিশু ক্ষুধার কারণে স্কুল মিস করবে না; যেখানে ফুটপাথে জন্মানো আর অ্যাপার্টমেন্টে জন্মানো শিশুর পার্থক্য থাকবে না। শিক্ষা সেখানে হবে আনন্দের, স্বাস্থ্য হবে অধিকার, আর কাজ হবে সম্মানের। এমন এক রাষ্ট্রে Save the Children, মজার ইশকুল, UNICEF কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠান, সবাই কাজ করবে একই লক্ষ্যে, একই বিশ্বাসে, “Every child deserves a future.”
এই বাংলাদেশ কেবল সরকারের দায়িত্ব নয়, বরং এটি তরুণদের মিশন। কারণ বৈষম্যের দেয়াল ভাঙার জন্য প্রয়োজন কেবল নীতি নয়, দরকার অদম্য ইচ্ছাশক্তি, সংগঠন আর ভালোবাসা। আমি বিশ্বাস করি, তারুণ্যের হাত ধরেই গড়ে উঠবে সেই বাংলাদেশ, যেখানে জন্ম নয়, অধিকার নির্ধারণ করবে ভবিষ্যৎ।
৬। বাস্তব উদাহরণ: রাস্তায় শুরু, ভবিষ্যতের পথে
আমাদের মজার ইশকুলের গল্প যদি বলি, তাহলে শুরু হয় এক মেয়েকে দিয়ে, কুলসুম খাতুন। ২০১৪ সালে সে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল আকাশের নিচে বসা এক ক্লাসে। আজ, ২০২৫ সালে, সে এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কুলসুম এখন তার পরিবারের সবচেয়ে শিক্ষিত সদস্য। তার বাবা, যিনি একসময় দিনমজুর ছিলেন, ২০১৭ সালে আমাদের সহায়তায় একটি রিকশা পান। আজ সেই মানুষটি রিকশা থেকে সিএনজি চালক হয়েছেন, জমি কিনেছেন, ঋণমুক্ত জীবনযাপন করছেন। তাদের এই গল্প আমাদের ভাষায় টেকসই উন্নয়ন, যেখানে শিক্ষাই পুরো পরিবারের ভবিষ্যৎ বদলে দেয়। সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে আছে একটাই শক্তি: কুলসুমের পড়াশোনা।
একই ক্লাসের আরেক শিক্ষার্থী মীমের গল্প আরও অনুপ্রেরণাদায়ক। মীমের চোখে দেখা প্রায় নেই; রাতে সে কিছুই দেখতে পায় না। কিন্তু দিনের আলো আর মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে সে বইয়ের অক্ষরগুলো বড় করে দেখে পড়ে। একসময় মায়ের সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় হাত পাতত, আর আজ সে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির সম্মানিত শিক্ষক, যার নিজের উপার্জনেই সংসার চলে।
মীম গান গায়, কবিতা লেখে, আর সবচেয়ে বড় কথা, সে এখন জীবনের গান গাইছে। এই কুলসুম আর মীমদের গল্পই প্রমাণ করে, তারুণ্যের জয় মানে সমাজে আলোর দাগ টেনে দেওয়া। তারা প্রমাণ করেছে, যেখানে সুযোগ দেওয়া হয়, সেখানেই সম্ভাবনা জেগে ওঠে।
৭। আমার বিশ্বাস
আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের তরুণদের অপরিসীম সম্ভাবনা আছে। আমি সব সময় ফোকাস আর ডিসিপ্লিনে বেশি গুরুত্ব দিই। আমার ধারণা, জীবনে সাফল্য পেতে জটিল কিছু নয়, বরং কিছু বেসিক বিষয় ঠিকভাবে মেনে চলাই যথেষ্ট।
দেশপ্রেম থাকলে, আর সঠিক প্রস্তুতি নিতে পারলে, বাংলাদেশের তরুণরা নিজের ভাগ্য যেমন বদলাতে পারে, তেমনি দেশকেও বদলে দিতে পারে। আমরা যদি নিজেদের স্বপ্নে অন্যের ভাগ রাখি, তবে একদিন আমরাই লিখব নতুন ইতিহাস, একটি বৈষম্যহীন, সম্মানপূর্ণ, মানবিক বাংলাদেশের।
তারুণ্যের জয় মানে নিজের উত্থান নয়, সবার উত্থান নিশ্চিত করা।
৮। উপসংহার
প্রথম আলো ২৭ বছর পূর্ণ করল। এই সময়ে তারা তারুণ্যের কণ্ঠস্বরকে প্রতিনিয়ত উজ্জীবিত করেছে। আমি এই বিশেষ সংখ্যায় একটাই কথা বলতে চাই, “যখন প্রতিটি তরুণ তার ভেতরের মজার ইশকুল খুঁজে পাবে, তখনই বাংলাদেশ সত্যিকারের বৈষম্য মুক্ত হবে।”
আমাদের কাজ চলছে, রাস্তা থেকে শ্রেণিকক্ষে, ক্ষুধা থেকে স্বপ্নে। বাংলাদেশে, যেখানে কোনো শিশু রাস্তার পাশে নয়, ভবিষ্যতের পথে হাঁটবে। আমরা লিখতে চাই শুধু ‘শিশু’, মুছে দিতে চাই ‘পথশিশু’।
-EDIT%20(1).jpg)
Comments
Post a Comment