মানুষ নয়, সিস্টেম টিকে থাকে

 


আমরা টিম মেম্বার বাছাইয়ে এখন অনেক বেশি স্পেসিফিক হচ্ছি। আগে ভাবতাম, “দক্ষতা”ই সবচেয়ে বড় যোগ্যতা; এখন বুঝি “মনোভাব”ই সবচেয়ে মূল্যবান। আমরা এমন টিম মেম্বার যুক্ত করছি যারা শুধু একটি চাকরি নয়, নিজের ক্যারিয়ারকে ডেভেলপমেন্ট সেক্টরের ভবিষ্যতের সঙ্গে দেখতে চায়। কারণ যারা এই সেক্টরকে জীবনের অংশ হিসেবে নেয়, তারাই একদিন পরিবর্তনের স্থপতি হয়। ধীরে ধীরে এই চিন্তা থেকেই আমাদের টিমের মধ্যে একধরনের অভ্যন্তরীণ সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে,  যেখানে দায়িত্ববোধ, শেয়ার্ড পারপাস, আর একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা কাজের মূল চালিকা শক্তি।

আমরা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছি যেখানে প্রতিটি টিম মেম্বার জানে, এই প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকার শক্তি ব্যক্তির ওপর নয়, সিস্টেমের ওপর নির্ভর করে। জব সিকিউরিটি এখানে মানে কেবল বেতন নয়, বরং একটি উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকা। ডেভেলপমেন্ট সেক্টরের কাজ কর্পোরেট সেক্টরের থেকে ভিন্ন ,   এখানে প্রোডাক্ট বিক্রি হয় না, বরং সমাজে পরিবর্তন আনা হয়। ফলে টিমের মানসিকতা, মূল্যবোধ, ও মিশন-বোধই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় পুঁজি।

দক্ষিণ এশিয়ার কিছু সফল সংস্থা এ মডেলেই এগিয়েছে। যেমন, BRAC,   যেখানে স্যার ফজলে হাসান আবেদ দক্ষতার চেয়ে মনোভাবকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, “Teach the right people the right way, and they will build the system that lasts.” তাই ব্র্যাকের শতাধিক দেশে প্রকল্প টিকে আছে, কারণ প্রতিটি কর্মীর মধ্যে একটি সিস্টেম-কেন্দ্রিক চিন্তা তৈরি হয়েছে। একইভাবে ভারতের Tata Trusts-ও শুরুতে বিশেষজ্ঞদের পরিবর্তে প্রতিশ্রুতিশীল মানুষদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বড় করেছে। ফলাফল,   সংস্থাগুলো ব্যক্তিনির্ভর নয়, কাঠামোনির্ভর হয়েছে।

এই মডেলটি বিশেষভাবে কার্যকর ফান্ডরেইজিং টাস্কের জন্যও। ফান্ডরেইজিং-এ ধারাবাহিকতা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ এখানে সম্পর্ক গড়ে তুলতে সময় লাগে, আর ফলাফল তাৎক্ষণিক আসে না। যদি টিমের মানসিকতা দীর্ঘমেয়াদি না হয়, তবে ডোনর হারানোর ঝুঁকি থেকে যায়। কিন্তু যখন আমরা সংস্থার উদ্দেশ্যের সঙ্গে আবেগগতভাবে যুক্ত থাকি, তখন আমরা শুধু ফান্ড সংগ্রহ করি না ,   ডোনরের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করি, রিপোর্টিংয়ে স্বচ্ছতা রাখি, এবং একে একে সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করি। এই বিশ্বাসই একসময় নতুন ফান্ড, নতুন অংশীদার এবং বড় নেটওয়ার্ক তৈরি করে।

আমরা Mojar School-এর ফান্ডরেইজিং মডেলেও এই পদ্ধতিই অনুসরণ করছি। প্রতিটি টিম মেম্বার জানে ,   ফান্ড মানে শুধু টাকা নয়, এটি বিশ্বাসের প্রতিফলন। আমরা রিপোর্টিং, আপডেট, ও ইমপ্যাক্ট স্টোরি একসাথে তৈরি করি যেন দাতা শুধু দান না করে, অনুভবও করে যে সে পরিবর্তনের অংশ। আমাদের টিম মেম্বাররা স্বাভাবিকভাবে দাতাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে পারে, কারণ তাদের কাজের ভিতেই সত্যতা আছে।

এই প্রক্রিয়ায় রিস্কও আছে। কেউ কেউ হয়তো দ্রুত ফলাফল না পেয়ে হতাশ হয়, কেউ আবার কর্পোরেটের তুলনায় ধীর গতিতে কাজ দেখে বিভ্রান্ত হয়। কিন্তু আমরা দেখেছি, যারা শিখতে চায়, ধৈর্য ধরে এগোয়, তারাই একসময় প্রতিষ্ঠানের ভরসা হয়ে ওঠে। তাই আমরা সবসময় বলি ,  “We don’t hire for performance, we hire for purpose.”

বাংলাদেশের বাস্তবতায় যেখানে দক্ষতা, স্থায়িত্ব, এবং সুযোগ ,  তিনটাই সীমিত, সেখানে এই মডেলই সবচেয়ে বাস্তবভিত্তিক। কারণ আমরা হয়তো সর্বোত্তম ট্যালেন্ট সবসময় পাই না, কিন্তু আমরা এমন টিম মেম্বার তৈরি করতে পারি যারা মনোযোগ, সততা, আর শিখতে চাওয়ার মানসিকতায় সেরা হয়ে উঠবে।

শেষ পর্যন্ত, প্রতিষ্ঠান টিকে থাকে সিস্টেমে, আর সিস্টেম টিকে থাকে টিম মেম্বারের বিশ্বাসে। আজ আমরা Mojar School-এর অংশ হয়ে জানি ,   কাজ মানে শুধু দায়িত্ব নয়, বরং দেশের শিশুদের জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা। আর সেটাই আমাদের সত্যিকারের ফান্ডরেইজিং ,  অর্থ নয়, বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এক শক্ত কাঠামো।

Comments