আমি কয়েকটা অভিনব জিনিস পেলাম মজার ইশকুলে - জীশান কিংশুক হক

 

আর এই হচ্ছে আরিয়ান ... শত বাধার মুখে সবকিছু জয় করার এই হাসি অমূল্য!


✮ মজার ইশকুল ✮

দশ বছর আগে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৩টি পথশিশুকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে শুরু হয় 'মজার ইশকুল'।
আজ সেই স্কুলের পাকা দালানের ৪টি স্থায়ী শাখা; ১,০৫০ জনের বেশী পথশিশু সেইগুলোতে পড়ছে।
আমার সাথে Arian Arif-এর পরিচয় কীভাবে, সেটা মনে নেই। কীভাবে যেন সে আমাকে মজার ইশকুলে ‘জিসান' নামের একটি বাচ্চার শিক্ষার সমর্থনের সুযোগ করে দিলো। মাঝেমধ্যেই জিজ্ঞেস করতো এইটা ঐটা, পরামর্শ চাইতো, আপডেট দিতো। আমাকে ইমেইলে প্রতি মাসে জিসানের পড়া এবং উপস্থিতির রিপোর্ট দেয়া হতো।
মজার ইশকুলে প্রথম গেলাম ২০২১ সালে তাঁদের আগারগাঁও শাখায়, যেখানে 'জিসান' পড়ে। সেই প্রথম জিসানের সাথে দেখা।
আমি তার সাথে টুকটাক কথা বলতে গিয়ে এক জায়গায় সে বললো, বড় হয়ে এস্ট্রোফিজিসিস্ট হবে!
আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকলাম।
ছেলেটি তখন ক্লাস সিক্সে। এই ছেলে এতো কঠিন জিনিস কীভাবে শিখছে! মানুষের আগ্রহ ঠিক কতখানি, স্বপ্ন ঠিক কতটা বড়!
সম্পূর্ণ অনুদানে চলা স্কুল। কারো অনুদান আর্থিক, কারো জিনিস দিয়ে, কারো মেধা দিয়ে। এখানে বুয়েটের ছাত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স ছাত্রী, এমন অনেকে শিক্ষক যারা প্রায় সকলেই নামমাত্র বেতনে পড়ান, কারণ এটা তাদের মনের খোরাক যোগায়।
আমি কয়েকটা অভিনব জিনিস পেলাম মজার ইশকুলে

- স্কুলে কোন রোল নম্বর নেই — সবাই আই ডি নম্বরে পরিচিত। কারণ কাউকে প্রথম হবার প্রতিযোগিতায় নামতে যেন না হয়
- প্রত্যেকটা ক্লাসরুম এক এক জন বীরশ্রেষ্ঠর নামে পরিচিত। যেন বাচ্চারা কোন রুমে ক্লাস হচ্ছে বা আছে এটা বলার ছলে প্রত্যেক বীরশ্রেষ্ঠর নাম মুখস্থ করে ফেলতে পারে
- পরীক্ষায় টার্গেট হচ্ছে গত পরীক্ষার চেয়ে একটু বেশী নম্বর পাওয়া — নিজের সাথে নিজের প্রতিযোগিতা, অন্য কারও সাথে নয়
- রিপোর্টিং টাইম সবসময় ঠিক থাকে — বাচ্চারা ঠিক সেইটা মেনে চলে - সময়ের দাম এদের কাছে অসামান্য
আজকে ইফতার করেছি ইশকুলের বাচ্চাদের সাথে।
বাচ্চাদের ভেতর কোন সঙ্কোচ নেই - তাদের সাথে বসলে আপনার মন এমনিই ভাল হয়ে যাবে।
ইফতারের আগে ঘুরে ঘুরে গল্প করলাম। জিসান এখন আরও বড়। তার ক্লাসে আরেকটি মেয়ে আছে - রাজা নেই, কিন্তু সে রাণী (তাঁর নামই রাণী, সে মোটামুটি ক্লাসের লিডার)। সে-ই আরিয়ানকে এবার বলেছে, একদিন ইফতার করতে চায় স্কুলে। সে যেদিন বলেছে, কাকতালীয়ভাবে সেদিনই আরিয়ানের সাথে আমার কথা হয়েছে ইফতারের আয়োজনের।
আমি তাদের সাথে গল্প করতে গিয়ে বুঝলাম, স্কুলটাতে তাদের কী পরিমাণ ভালবাসা। তারা দেয়ালে দেয়ালে রং করেছে। নতুন নতুন জিনিস শিখতে চায়। জিসান এই দুই বছরে একটু চিন্তা করেছে, এস্ট্রোফিজিসিস্ট হওয়াটা কঠিন হতে পারে, এইটা বোঝে, কিন্তু এখনো বিজ্ঞানীই হতে চায়।
রাণী আমাকে বললো, তাঁদের স্বপ্ন, স্কুলে কম্পিউটার শিখবে! আমি আবারও চমকে উঠলাম — কতটা ভবিষ্যৎ নিয়ে পথের একটা শিশু আত্মবিশ্বাসী।
আরিয়ান তখন বললো, ভাইয়া, আপনার মতো আর কাউকে যদি ইফতারে নিয়ে আসতেন, তাঁরা দেখতো সমস্তকিছু, হয়তো কম্পিউটার হয়ে যেতো!
ঠিক এই জন্য এতকিছু লিখলাম।
আপনাদের স্কুলে নিয়ে যেতে পারিনি, কিন্তু কিছুটা যদি শেয়ার করতে পারি, সেইজন্য।
যদি এই লেখা পড়ে কারো মনে হয় আপনি একটা বাচ্চাকে পড়ানোর দায়িত্ব নিবেন, কিংবা আপনার পুরনো কম্পিউটার বা ডিভাইসটা দিয়ে দিবেন, কিংবা অন্য কোনভাবে যে কোন একটা বাচ্চার স্বপ্নের সাথে হাঁটবেন, তাহলে হয়তো এই লেখাটা সার্থক হবে।
.
.
.
(ডিস্ক্লেইমারঃ আপনারা যারা আমাকে চেনেন, তারা ভাল করেই জানেন যে আমার এই ধরণের কাজের কথা সহজে বলি না।
কিন্তু আজকেরটা শেয়ার করলাম … কারণ আমার মাধ্যমে যদি আর একটা পথশিশুও যদি শিক্ষার আর সুস্থ জীবনের আলো দেখে, নিশ্চয়ই আল্লাহ সেটাতে নারাজ হবেন না।
আর বাচ্চাদের ছবি তাদের অনুমতি নিয়েই দিয়েছি। আমাকে উল্টো জিজ্ঞেস করেছে, ট্যাগ করব কিনা!)


জিসানের সাথে আমার প্রথম দেখা - এই ছবিটা ২০২১-এরএই হচ্ছে এখনকার জিসান - আরেকটু বড় হয়েছে, আগের চেয়ে আরও 'ম্যাচুরড' মাশাল্লাহ ... আর খানিকটা লাজুক। হাসিটা দেখেন - কী অমলিন!




Comments