জাহানারা ইমাম এর ‘একাত্তরের দিনগুলি’
জাহানারা ইমাম এর ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটি পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে এ যেন কোন এক মা তার আদরের সবটুকু পেলব মিশিয়ে অক্ষরের জালে বুনেছেন এক নকশী কাঁথা। যার ফোঁড়ে ফোঁড়ে রয়েছে সুচ-ফোটা যন্ত্রণা, রয়েছে মশালের জৌলুশ, বারুদের গন্ধ, মুহুর্মুহু গুলির ঝংকার। আরও রয়েছে বিশ্বাসঘাতকদের প্রবঞ্চনার দগদগে ঘা, রয়েছে উদ্বিগ্ন মায়ের বিনিদ্র রাত্রিযাপনের রুদ্ধশ্বাস বয়ান।
১লা মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৭ই ডিসেম্বর ১৯৭১। জাহানারা ইমাম এ বইটিতে তুলে এনেছেন এই সময়টাকে, তাঁরই ব্যক্তিগত দিনলিপি আকারে। বইটি পড়তে গিয়ে এক সময় লেখিকাকে মনে হয় খুব আপনার। আপন করে নিই তাঁর সন্তান রুমী-জামীকে। আত্মীয়তায় বাঁধা পড়ে যান তাঁর সংগ্রামী দেশপ্রেমিক স্বামী শরীফ ইমামও।
লেখিকা যখন উত্তাল মার্চের কথা বলেন তখন উত্তপ্ত বাতাসের হলকা ছুঁয়ে যায় আমাকেও। জননী যখন ৭ই মার্চের কথা লেখেন তখন আমিও যেন নিজেকে আবিষ্কার করি রুমী-জামী-শরীফ কিংবা কাজের লোক সুবহান-বারেকের পাশে, অধীর আগ্রহে বসে থাকি ‘শেখের’ বক্তৃতা শুনব বলে। স্পষ্ট দেখতে পাই সেই মানুষগুলোকে যারা চব্বিশ ঘণ্টার পথ পায়ে হেঁটে গামছায় চিড়ে-গুড় বেঁধে সেদিন হাজির হয়েছিল রেসকোর্স ময়দানে।
তখন আমার জন্মও হয়নি। অথচ বইটি পড়তে গিয়ে ২৫ শে মার্চের কালো রাত আমার সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে। নিজের কাছে প্রশ্ন করি, আসলে কি কালো ছিল রাতটা? নাকি আগুনের লেলিহান শিখা আর রক্তের ফল্গুধারায় সেজেছিল সে রক্তকরবী! বইয়ের পাতা উল্টাতেই পুড়ে যেতে দেখি ঘরবাড়ি, বস্তি, কাঁচা-বাজার। সেই সাথে মানুষও। মুহুর্মুহু গুলিতে কেঁপে উঠতে দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। আরও এগোলে আঁৎকে উঠি পাকিস্তানী নরপিশাচদের হাতে নির্মমভাবে নিরস্ত্র বাঙালিদের জবাই হতে দেখে। বইয়ের পাতায় পাতায় দেখতে পাই বিহারিদের নৃশংসতা, ধারালো ছুরির দেবে যাওয়া তাজা মানুষের গলায়।
বইটি পড়তে গিয়ে জানতে পারি তখন রুমীর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাওয়া ঠিক হয়ে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইনিস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে। কিন্তু দেশের সেই ক্রান্তিলগ্নে লেখাপড়া করে মানুষ হওয়ার প্রক্রিয়াটা রুমীর কাছে বড্ড ‘সেকেলে’ মনে হয়। মায়ের কাছে তাই সে বিদেশে পড়তে যাওয়ার বদলে অনুমতি ভিক্ষা করে যুদ্ধে যাওয়ার।
যুদ্ধে যাওয়ার আগের দিন রাতে রুমী মায়ের কাছে বায়না ধরে, ‘আম্মা, আজকে একটু বেশি সময় মাথা বিলি করে দিতে হবে কিন্তু।’ সেদিন ছোটভাই জামীও উদার। বলে ওঠে, ‘মা, আজ আর আমার মাথা বিলি করার দরকার নেই। ওই সময়টাও তুমি ভাইয়াকেই দাও।’ মা রুমীর মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে থাকেন। আমার চোখ ভিজে আসে, ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টি।
শহীদ জননী বলেছিলেন ‘দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা, তুই যুদ্ধে যা।’ তাই রুমী যুদ্ধে যাচ্ছে, টের পাই। কোন পিছুটান নেই তাঁর। কাঁধে এয়ারব্যাগ, তার মধ্যে টুকটাক কাপড়-চোপড়, তোয়ালে, সাবান, স্যান্ডেল আর দু’টো বই- ‘জীবনানন্দের শ্রেষ্ট কবিতা’ আর ‘সুকান্ত সমগ্র’।
মেলাঘর থেকে ট্রেনিং নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসে রুমী, বিশেষ অপারেশনে। তাঁর বয়ানে শুনি ‘রূপকথার চেয়েও রোমাঞ্চকর’ সব কাহিনী; রক্ত পানি করা ট্রেনিং, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা শুশ্রূষার জন্য হাসপাতাল স্থাপন, তাদের অপারেশনের রোমহর্ষক বর্ণনা। পাক আর্মিদের চোখের পলকে ধরাশায়ী করে হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া, কিংবা সেতু, পাওয়ার স্টেশন ইত্যাদি উড়িয়ে দেওয়ার গল্প শুনে গর্বিত হয়ে উঠি সেই সব গেরিলাদের জন্য যারা জানে, ‘কোন স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায় না; চায় রক্তস্নাত শহীদ।’
আগস্টের শেষে এসে দেখি তথাকথিত ‘দেশপ্রেমিক নাগরিক’ রাজাকারদের গোপন তথ্যের ভিত্তিতে রুমী-জামী-শরীফদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রেপ্তার হয় আরও অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা, ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে। উদ্ধার হয় বিপুল অস্ত্রশস্ত্র। সবার উপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। এক সময় শরীফ-জামী-অন্যান্যরা বাড়ি ফিরে এলেও রুমী আর ফিরে আসে না।
সময় প্রবাহিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ দানা বাঁধতে থাকে। বাংলার টগবগে দামাল ছেলেদের গেরিলা বাহিনী, তাদের সহযোগী ভারতীয় মিত্র বাহিনী। তাদের আক্রমণের তীব্রতায় নাজেহাল হতে থাকে পাক-বাহিনী। যখন স্বাধীনতার সূর্য পুব আকাশ রাঙিয়ে উঠবে উঠবে করছে, ঠিক সেই সময়, ১৩ই ডিসেম্বর লেখিকা হারান তার স্বামী শরীফ ইমামকে।
জননী লিখে যান, ‘আকাশের বুকেও অনেক ব্যথা। তার কিন্তু আমার মতো চেপে রাখার দায় নেই।’ বইটিতে তাই লক্ষ্য করি, জননী ‘চেপে রাখার দায়’ নিয়ে, বুকের কষ্ট বুকেই দাফন করে সময়ের নির্যাস তুলে রাখেন তাঁর রোজনামচায়। সে রোজনামচায় দেখা মেলে ২৫শে মার্চের বর্বরোচিত হামলার পরেও কিভাবে বাঙালি ঘুরে দাঁড়াল, শোক কিভাবে তাদের হৃদয়ে শক্তির বীজ বুনল। যারা বাঙালির রক্তক্ষয়ী সে সংগ্রামের ইতিহাস বক্ষে ধারন করে হতে চান সত্যাগ্রহী, তাদের জন্য ‘একাত্তরের দিনগুলি’ এক অবশ্য-পাঠ্য গ্রন্থ বলে মনে করি, পরিশেষে এই একটি কথাই বলব।
Comments
Post a Comment