পদ্মা সেতু ও মাওয়ায় তাবুতে ক্যাম্পিং // TENT & Life :: Tent Camping in Bangladesh

 জীবনে তাবুতে থাকার আগ্রহ তৈরি হয়নি, নানান কারনেই হয়ে উঠেনি। কেন আরেকদিন খুঁজবো। 

খুব ছোট করে বলি, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রথমবার "নিঝুম দ্বীপে" তাবুতে থাকার সুযোগ তৈরি হয় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুদের কল্যাণে। এরপর ২০২২ সালে আরও একবার পাহাড়ে ক্যাম্প করার সুযোগ পাই ২০২২ সালেই। 

কিন্তু কোনটাই আমি সরাসরি আয়োজন করিনি, আয়োজক ছিল স্থানীয় মানুষ যারা ভাড়া বা চুক্তি ভিত্তিক ভাবে এই আয়োজন করে। 

প্রথমবার দারুণ অভিজ্ঞতা হলেও, দ্বিতীয়বার শীতে যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছিল। 

এবার নিজে নিজে আয়োজনের পালা। ইচ্ছা ছিল বছরের শুরুতেই যাওয়ার, সেই হিসেবে তাবুও ধার করেছিলাম কিন্তু কোন ভাবেই সময় মিলাতে পারছিলাম না। 

শেষ পর্যন্ত ডিসেম্বর ১, ২০২২ সুযোগ আসলো মাওয়া যাওয়ার, পদ্মা সেতুর রাতের রুপ দেখবো, সাথে পদ্মা নদী। দারুণ হবে এমন আশায়। 

.

আমাদের প্রথম ক্যাম্প 

আমি আর আরিয়ান পহেলা ডিসেম্বর আমাদের প্রথম ক্যাম্পের উদ্দেশ্য রওনা দেই। শীতের দুপুরে কড়া রোদে বনানী থেকে রওনা দেই। বিকাল চার টার আগেই এক্সপ্রেস হয়ে পৌছে যাই আমাদের লোকেশনে। লোকেশন হিসেবে নির্বাচন করি মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার যশলদিয়া গ্রামকে। পদ্মা ব্রিজের নিজ দিয়ে ১/১.৫ কিলো দূরে পদ্মার তীরে ক্যাম্পের লোকেশন ফিক্সড করি।প্রথমবার ক্যাম্পিং হিসেবে আদর্শ জায়গা কারন হাতের কাছেই সব কিছু পাওয়া যাবে এবং আশেপাশের লোকজন অভ্যস্ত। একটা এডভান্টেজ পাশের দোকানের আন্টির সাথে আলোচনা করে বাজার করে দিলে তারা রাতের রান্না করে দিতে পারবে। এছাড়েও সকালের নাস্তার সুযোগ আছে। নামাযের জন্য অল্প দুরেই মসজিদ। 


লোকশনে ঘুড়ে চলে যাই একটু দূরেই একটা মাঠে, মাওয়া রিসোর্টের পাশে। স্থানীয় লোকজনদের সাথে ক্রিকেট খেলা জমে উঠছিলো কিন্তু তখন ই ছোট একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়। ক্যাচ ধরতে গিয়ে আরিয়ান পড়ে গিয়ে পা মচকে ফেলে। ছোটখাটো ভোগান্তির শুরু হয়। ভাগ্যক্রমে পাশেই লোকাল ফার্মেসি ছিলো সেখান থেকে তাতক্ষনিক ব্যাথার ওষুধ আর মুভ কেনা হয়। সেখানে প্রায় ২৫০ টাকা এক্সট্রা খরচ হয়। মোটামুটি স্বাভাবিক হলে আমরা ক্যাম্প এর লোকেশনে ফেরার সিদ্ধান্ত নেই। পথেই হাসের সিদ্ধ ডিম আর চালের চাপটি ভর্তা দিয়ে খাই। গরম মচমচে চাপটি ঝাল ঝাল ভর্তার সাথে শেষ বিকালে খেতে অসাধারণ লাগছিলো। চাপটি গুলো মাত্র ১০ টাকা করে সাথে ভর্তা ফ্রি। সন্ধ্যা নামো নামো করছে এমন সময় আমরা তাবু খাটানো শুরু করি। পদ্মার ওপারে সূর্য ডুবছে, আনাড়ি দুজন প্রায় নিখুত ভাবে তাবু খাটিয়ে ফেলি। আসেপাশের উৎসুক জনগন মাঝে মাঝে দেখে যাচ্ছিলো আমাদের পাগলের কারবার। শীতে পদ্মার যৌবন হারিয়ে যায়, দুজন দাঁড়িয়ে শেষ সন্ধ্যাটুকো ক্ষীনস্রোতের পদ্মা দেখে কাটিয়ে দিলাম।


সন্ধ্যার নামার পর আরিয়ান এর পা ব্যাথা নতুন মোড় নেয়, কিছুটা বেড়ে যায়। স্থানীয় দোকান থেকে হালকা নাস্তা করে দ্বিতীয় দফায় ওষুধ নেয়। প্রায় রাত সাড়ে ৯ টায় হুট করে ভাতের ক্ষুদা জাগ্রত হলো। যা ভাবা তাই কাজ তাবু ওভাবেই রেখে বেড়িয়ে পড়ি মাওয়ার দিকে। এখন ২০২২ ডিসেম্বরের প্রথম দিন হিসবে শহরে তেমন শীত ছিলো না কিন্তু মাওয়া যাওয়ার পথে ঠান্ডা বাতাসে শীতের অনুভূতি হয়। রূপসী বাংলা হোটেলে আমরা খেতে বসি। গরম ভাত এর সাথে ইলিশ, নানা পদের ভর্তা আর বেগুন ভাজি ছিলো তালিকায়। সব কিছুর দাম সবার শেষে একত্রে দিয়ে দিচ্ছি শেষে গল্পে ফিরি, রাতে ফিরে দেরি না করে তাবুতে ঢুকে যাই। 


তাবুতে সব ঠিক ঠাক থাকলেও মশার উৎপাত ছিলো ভয়ংকর। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। একসাথে দলবল গেলে মৃদু স্বরে গান গাওয়া যেতে পারে তবে আশেপাশে গ্রামবাসি থাকায় উচ্চস্বর কিংবা বেশি হৈ হুল্লোড় করা ঠিক হবে না । আকাশ পরিষ্কার থাকলে মধ্যরাতে ঝলমলে তারা দেখা যাবে। নদীর ঘাট আছে ক্যাম্পের স্থানের সাথে, ইচ্ছা করলে রাতে বসে নদীর শীতল বাতাস উপভোগ করা যাবে। 


সকাল সকাল ঘুম ভেঙে দেখতে পাই কুয়াশায় আচ্ছাদিত নদী যার কোন শেষ দেখা যাচ্ছিলো না। স্থানীয় একদল ছোট ছোট নৌকা নিয়ে মাছ ধরছিলো। রান্নার জিনিসপত্র সাথে নিয়ে গেলে তাদের সাথে কথা বলে মাছ কিনা সম্ভব হবে তখন তাজা মাছ ভেজে ভাত খাওয়া যাবে তাবুতে বসে। সকালে গরম গরম পরোটা আর ডাল ভাজি সেখানে পাওয়া যায় তাছাড়া চা, রুটি, কলা বিস্কিট সব কিছুই পাওয়া যায়। সকালে আরিয়ানের পায়ের ব্যাথা আরো বেড়ে যায়। ওষুধ এর পাশাপাশি গরম পানি পায়ে ঢালা হয়। নাস্তার শেষে আমরা আরো ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নেই। দুপুর বারোটার দিকে আরিয়ানের পায়ের ব্যাথা কিছুটা কমে এলে আমরা তাবু গুছিয়ে রওনা হই ঢাকার পথে। প্রথম ক্যাম্প ছিলো তাই এক্টিভিটিস কিছুটা কম আর ছোট দুর্ঘটনা টি না ঘটলে আমরা আরো কিছু হয়তো উপভোগ করতে পারতাম। 



কীভাবে যাবেন ?


ঢাকা থেকে যেতে হলে গুলিস্থানের যেকোন মাওয়াগামি বাসে উঠে গেলেই হবে। পদ্মাসেতুর নিচ দিয়ে বামে বাস ঘুড়ে মাওয়ার ঘাট এর দিকে যায় সেদিকে না গিয়ে ডানে যেতে হবে। যশলদিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় বললেই যেকোন অটো নিয়ে যাবে সেখানে। অটো থেকে নেমে মিনিটের হাটা পথ পৌছে যাবেন ক্যাম্পের লোকেশনে। 


খরচ কেমন হবে? 


যাতায়েতে খরচ হবে আনুমানিক ৫০০-৭০০ টাকার মত দুজনের  

রাতের খাবারে আমাদের খরচ হয় ৬০০টাকা 

স্নাকসে খরচ হয় ৩০০ টাকা 

শেষে সকালের নাস্তায় খরচ হয় ১০০ টাকার মত 


 সবশেষে বলা যায় প্রথম ক্যাম্প হিসেবে অভিজ্ঞতা ভালো হবে। সব কিছু কাছাকাছি পাওয়া যাবে। আশেপাশের গ্রামবাসি খুব ই আন্তরিক। যেকোন সমস্যায় কাছে এগিয়ে আসবে। যেখানেই যান আশেপাশের পরিবেশ নোংরা করবেন না।










Photo Collected / Meer Sadi






নিজেদের আয়োজনে ১ম তাবুতে ক্যাম্পিং অভিজ্ঞতা ( আরিয়ান আরিফ ),

আমি আর রাহাত ছিলাম এই ক্যাম্পের ক্যাম্পার। ট্যুর মেট ট্যুরে গুরুত্বপূর্ণ। যে মেট আপনাকে বেটার ফিল নষ্ট করতে পারে এমন কাউকে সাথে নেয়া বা সাথে যাওয়া উচিত না। রাহাতের সাথে এর আগেও আমি ট্যুর দিয়েছি, সে আগের থেকেও পরিপক্ক মনে হয়েছে। 

খাবারের কোন আয়োজন নিজেরা করিনি, যেহেতু ১ম বার। পরে অবশ্যই নিজেরা করার ইচ্ছে। হালকা খাবার, ভারি হলে বারবি-কিউ হবে। 

মশা মারার ব্যবস্থা থাকা উচিৎ, যা আমাদের ছিল না। সাথে বই নিয়েছিলাম, পা মচকে যাওয়ায় পড়ার সময় পাইনি, পদ্মায় গোসল করতে পারিনি একই কারনে, যদিও নতুন জায়গায় পানিতে না নামতে পারলেই ভালো। 

পরের বার একটা ক্যাপ লাইট লাগবেই, গান গাইতে পারে এমন কেউ সাথে থাকলে দারুণ হয়। 

নিরাপত্তা যেহেতু বাংলাদেশে একটা গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু, সেটা মাথায় রেখেই ট্যুর প্ল্যান করা শ্রেয়। 

সব মিলিয়ে আমার অভিজ্ঞতা ভালোই বলবো, এবং এই বছর অন্তত আরও একটা ট্যুর দিতে চাই। 

তাবুতে প্রথম ক্যাম্পিং এর অভিজ্ঞতা (নিয়াজ মাসুদ রাহাত)

শীত না আসলেও শীতের  দুপুরে আমরা বাইকে চড়ে রওনা দেই আমাদের প্রথম ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে, কোথায় যাচ্ছি পূর্বেই জানা ছিলো। প্রথম ক্যাম্প কোন ঝুকি না নিয়ে এই প্রস্তুতি । দুদিন আগে আমরা দুজন দুটো রঙিন স্লিপিং ব্যাগ কিনে ফেলি। ডেকথলনে গিয়ে আরিয়ান ভাইয়ার বাচ্চার মত উল্লাসে ফেটে পড়ার গল্প অন্যদিন হবে। ভাইয়া মিস করলো হ্যামক খরিদ করা এটাও আশা করি নেক্সট ক্যাম্প এর আগে হয়ে যাবে। টুকটাক এসব প্রস্তুতি ছিলো। দুপুরের রোদে চেনা রাস্তায় একটা গোলক ধাধা করে শেষমেষ হানিফ ফ্লাইওভারে উঠে আমাদের মূল ক্রজিং শুরু হয়। খুব অল্প সময়ে ছুয়ে ফেলি মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে। দুপুরের সোনালী রোদ, ফাকা রাস্তা আর মিহি বাতাস একটা স্বর্গীয় আমেজ দিচ্ছিলো । আরিয়ান ভাইয়ার বয়স বেশি হওয়ায় ঠান্ডা মাথায় বাইক ক্রজ করছিলো আর আমি পিছনে বসে হাত নারা চারা করছিলাম। কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রিয় জেলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ভাইয়া জেল ভ্রমনের অভিনব উপায় দেয় কিন্তু সেসব খোলাখুলি ভাবে বলার সুযোগ নেই। প্রায় ঘন্টা খানেক পর পৌছাই মাওয়া, যশলদিয়া গ্রামের পদ্মা নদীর বাধ ধরে আমরা পৌছে যাই আমাদের লোকেশনে। 


প্রথম ক্যাম্প হিসেবে আদর্শ লোকেশন। হাতের কাছেই সব ছিলো , জায়গাটিও বেশ নিরাপদ। মধ্যরাতে সামনে বিশাল পদ্মা নদী আর আকাশে চোখ ধাধানো তারার ঝিলিমিলি। চারদিকে গাছ হ্যামক থাকলে লাগানো যেতো । মশার উপদ্রব ছাড়া সব কিছু দারুণ ছিলো। 


এত ভালো লাগার মাঝেও বিকালে স্থানীয় ছেলেপেলে দের সাথে ক্রিকেট খেলার সময় আরিয়ান ভাই পা মচকে ফেলে। বেশ ভুগতে হয়েছিলো । পরের বার থেকে ভাইকে বেধে রাখা লাগবে এমন হুট করে লাফালাফি থেকে। 


রাতে হঠাৎ সিদ্ধান্তে মাওয়া যাই ইলিশ খেতে। তখন বেশ ঠান্ডা লাগছিলো। পরিবেশ ও ভালোই সুন্দর ছিলো। গরম ধোয়া ওঠা ভাত আর কড়কড়ে ভাজা ইলিশ আত্মিক তৃপ্তি দিচ্ছিলো। খাওয়া শেষ করে আবার ফিরে যাই ক্যাম্পের জায়গায়। কিছুক্ষন হাটাহাটি করে ঢুকে যাই ক্ষনস্থায়ী বাংকারে। আমি খানিক ঘুমিয়ে প্রায় সারারাত জেগে ছিলাম। কিছু গান শুনছিলাম। নিজেকে নতুন ভাবে খুজে পেতে চাইছিলাম। এমন ক্যাম্প গুলো জীবনে একটা গতি এনে দেয়, বাস্তবিক সমস্যা সমাধানের পথা দেখায়। মানুষের কাছাকাছি থাকার সুযোগ করে দেয়। ভাবনার জগৎকে সমৃদ্ধ করে। ম্যাটারিয়েলেস্টিক দুনিয়ে যেভাবে আমাদের পঙ্গু করে রেখেছে এমন নিয়মিত উদ্যোগ সেই ছোবল থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে ।


Comments